খেলতে খেলতে নোয়াখালীর মাজেদা আক্তার ববি (২২) আহত হন ককটেল বিস্ম্ফোরণে। সে ঘটনায় হাত, চোখ ও শরীরের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার। এর পর নানা প্রতিবন্ধকতার ভেতর দিয়ে শেষ হয় তার লেখাপড়া। হতাশা, তিরস্কার ও নানামুখী সমস্যার মধ্য দিয়েও থেমে থাকেননি তিনি। শত বাধা পেরিয়ে এখন বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতির (বিপিকেএস) ইয়ুথ উইমেন উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিজ নেটওয়ার্ক লিডারশিপ হিসেবে কর্মরত ববি।
রাজধানীর উত্তরা এলাকায় মাজেদা আক্তার তার সফলতার পাশাপাশি অতীতে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার বর্ণনা দেন। তাতে উঠে আসে জীবনমুখী নানা বাস্তবতা, হতাশা ও সফলতার গল্প। এরই মধ্যে কখনও কেঁদেছেন, কখনও হেসেছেন। বলেছেন প্রতিবন্ধী নারী হিসেবে থেমে না থাকার গল্পও।
মাজেদা বলেন, ‘৩ বছর বয়সে বাবা মারা যান। তার মাসতিনেক পর বাড়ির পাশে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে থাকি আমি। হঠাৎ লাল রঙে মোড়ানো একটি বক্স (ককটেল) পাই সামনে। সেটা হাতে নিয়ে খেলতে থাকি। হঠাৎ ওটা আমার হাতেই বিস্ম্ফোরিত হয়। জ্ঞান হারিয়ে ফেলায় আমার আর কিছু মনে নেই। চিরতরে হারিয়ে ফেলি আমার দুটি হাত ও একটি চোখ। অপর চোখের আংশিক আলোও নিভে যায়। পুড়ে গিয়েছিল আমার মুখের একাংশ। তবুও থেমে থাকিনি আমার জীবনযুদ্ধে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিস্ম্ফোরণের পর আমি শৈশবের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হই। আর পাঁচজনের মতো মিশতে পারিনি মানুষের সঙ্গে। কারণ, আমাদের সমাজ ও আত্মীয়স্বজন আমাকে বোঝা ছাড়া আর কিছু ভাবত না। মা বলতেন, ছোটবেলায় আমি অন্য বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়া দেখে কাঁদতাম। তা দেখে মা আমাকে স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে যান। কিন্তু ওই স্কুলের শিক্ষকরা আমাকে ভর্তি নিতে রাজি হননি। এ কথা শোনার পর অনেক কান্না করি। পরে এলাকার গণ্যমান্য কয়েকজনকে ধরে আমাকে স্কুলে ভর্তি করান। কিন্তু আমার শিক্ষকরা কখনই আমার প্রতি আন্তরিক ছিলেন না। আমাকে দেখে সহপাঠীরা নাকি ভয় পেত! সে জন্য আত্মীয়রা আমাকে কোনো উৎসবে নিয়ে যেত না।’
মাজেদা বলেন, ‘প্রতিবন্ধী হওয়ায় সর্বক্ষেত্রে আমাকে সমস্যায় পড়তে হতো, যা ক্ষেত্রবিশেষ এখনও আছে। বাবা মারা যাওয়ার কারণে আর্থিক সমস্যা প্রকট ছিল। স্কুলের বেতনও দিতে পারতাম না। এভাবে নানা বাধার মুখোমুখি হয়েও প্রাইমারি লেভেল শেষ করি। ওই সময়ে একমাত্র মা-ই আমাকে সব কাজে সহযোগিতা করতেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় এ মাইনাস পেয়ে উত্তীর্ণ হই। তারপর বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতির (বিপিকেএস) সঙ্গে পরিচয় হয়। সেখান থেকে আমি কম্পিউটারের ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। আমার মায়ের পরে যাকে আমি সাফল্যের রোল মডেল হিসেবে দেখি তিনি হলেন আব্দুস সাত্তার দুলাল। তিনি নিজেও প্রতিবন্দ্বী। কিন্তু তিনি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবিষয়ক সীমাহীন পরিবর্তনের এক প্রতীক।’
মাজেদা বর্তমানে ডিগ্রিতে পড়াশোনা করছেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতির (বিপিকেএস) ইউথ উইমেন উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিজ নেটওর্য়াক লিডার হিসেবে বাংলাদেশের তৃণমূল পর্যায়ের প্রতিবন্ধী যুব নারীদের সঙ্গে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, ইচ্ছাশক্তি থাকলে পৃথিবীতে সবকিছু সম্ভব। চেষ্টা করেছি বলেই জীবনে সফলতা পেয়েছি। লক্ষ্যে পৌঁছাতে গেলে নিজের প্রবল ইচ্ছাশক্তির প্রতি মন দিতে হবে। অন্য দশজন কী বলছে, তার প্রতি খেয়াল করে নিজের মন খারাপ করার কিছু নেই। সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সব বাধাকেই নিজের ইচ্ছাশক্তি দিয়ে অতিক্রম করে সফল হতে হবে।’
শুধু মাজেদা নন, হাজার হাজার প্রতিবন্ধী নারী এভাবে সংগ্রাম করে সফলতা অর্জন করছেন। এদের কেউ জন্মগতভাবে প্রতিবন্ধী, কেউ আবার দুর্ঘটনার কারণে। তাদেরই একজন নাসরিন আক্তার। জন্ম থেকেই তার ডান হাত নেই। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘একটি শিশু যখন জন্ম নেয়, তখন মা শিশুটিকে কোলে নিয়ে অনেক আদর করে। কিন্তু আমার বেলায় ছিল ভিন্ন। মা আমাকে দেখে অনেক কান্না করে। আমার দাদা একদিন বলেছিল আমাকে মেরে ফেলতে। এ কথা আমার নানি আমাকে বলেছিল। বাবা আমাকে স্কুলে ভর্তি করে দিলেও সহপাঠীরা হাসাহাসি ও উপহাস করত সব সময়।’
নাসরিন আক্তার বলেন, “এভাবে নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে আমি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাজীবন শেষ করি। পরে ডিগ্রিতে ভর্তি হলেও কেউ আমার সঙ্গে মিশত না। মানুষের ‘আহা রে, মেয়েটা যদি এমন না হতো!’ বলা শব্দটার ভেতরে আমার সব আশা ভেঙে যেত। সারাক্ষণ অনেক ডিপ্রেশনে ভুগতাম। মাঝেমধ্যে মনে হতো, মারা যাই। পরক্ষণেই ভাবতাম, মারা যাওয়া কোনো সমাধান নয়। এদিকে বাবা বিভিন্ন স্থানে আমার চাকরির জন্য চেষ্টা শুরু করেন। আমি নিজেও চেষ্টা করি। যে অফিসেই যাই, সেখান থেকে ফিরিয়ে দেয় আমাকে। কারণ তারা কখনও আমার যোগ্যতা দেখেনি। দেখেছে- আমার একটা হাত নেই। চার বছর ধরে চাকরির জন্য চেষ্টা করেছি, কিন্তু কোথাও হয়নি। তারপর কম্পিউটারে প্রশিক্ষণ নিই। এর কিছুদিন পর বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতিতে আইটি সহকারী পদে চাকরি হয়। আমি আর এখন নিজেকে একা মনে করি না। এক ধরনের আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছি। মারা যাওয়াটা সত্যিই কোনো সমাধান নয়। এখন আমার পরিবার নিয়ে ভালো আছি।
Sharing is caring!
যোগাযোগ ঠিকানাঃ রেজিঃ কার্যালয়ঃ শেখ মঞ্জিল, আদালত পাড়া, ওয়ার্ড নং-৯, বরিশাল সদর, বরিশাল।
01711358963
01980222333
nomanibsl@gmail.com
fflbd18@gmail.com
©
Website Design and Developed by ENGINEERS BD NETWORK